নিজস্ব প্রতিবেদক: বাঙালি জাতি যেন আবারও দাঁড়িয়ে আছে এক সন্ধিক্ষণে। স্বৈরশাসনের বিদায়ের পর সামনে এসেছে এক নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি। সেই প্রতিশ্রুতির নাম— ‘জুলাই সনদ’।
তবে এই ‘সনদ’ কেবল কাগজের কয়েকটি বাক্য নয়, বরং এটি হতে যাচ্ছে একটি নতুন রাজনৈতিক যাত্রাপথের মানচিত্র, যার ওপর নির্ভর করবে আগামীর রাষ্ট্র কাঠামো ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ।
🟣 এক সনদের পেছনে বহু সন্ধ্যা
গত কয়েক মাস ধরে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন রাজনীতির বৈরিতার চোরাবালিতে নেমে খুঁজেছে সমঝোতার স্বচ্ছ জলের ধারা।
৩০টিরও বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে টানা বৈঠকে উঠে এসেছে ১৬৬টি সংস্কার প্রস্তাব। এর মধ্যে ৮০টির বেশি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে, তবে বাকিগুলো যেন এখনো ঘূর্ণিঝড়ের মাঝে দুলছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ জানালেন,
“সব মতের সমন্বয়ে একটি ঐতিহাসিক দলিল তৈরি করতেই চলছে আমাদের প্রয়াস— সেটাই হচ্ছে জুলাই সনদ।”
🟣 সনদ না কি ঘোষণাপত্র—দুটি পথ, দুটি দর্শন
‘জুলাই সনদ’ এবং ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’— দুটো শব্দ, অথচ ভিন্ন উদ্দেশ্য।
জুলাই সনদ: রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোর একটি সংকলন। এটি প্রস্তুত করছে ঐকমত্য কমিশন।
জুলাই ঘোষণাপত্র: একটি রাজনৈতিক ইশতেহারসদৃশ দলিল, যা সরকার ও রাজনৈতিক দল মিলে তৈরি করবে— সময়ের ডাক ও দায়বদ্ধতার প্রতিচ্ছবি।
অধ্যাপক রীয়াজ বলেন,
“জুলাই সনদ মানে শুধু জুলাই নয়, এ যেন এক চেতনার সনদ। যেন ভবিষ্যতের ইতিহাসবিদরা বলতে পারেন— ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশ নতুন করে ভাবতে শিখেছিল।”
🟣 কোন প্রস্তাবে মিল, কোনটিতে দ্বিধা?
ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি প্রস্তাব:
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন
সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব নিয়ে ভারসাম্য
নির্বাচনি সীমানা পুনর্নির্ধারণ
রাষ্ট্রপতির ক্ষমা বিধানে পরিবর্তন
হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ
তবে যেখানে টানাপোড়েন বেশি, তা হলো:
প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধানকে আলাদা করা
জাতীয় সাংবিধানিক পরিষদ গঠন
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগ পদ্ধতি
বিএনপির এক নেতা প্রশ্ন তুলেছেন,
“সব বিষয়ে যদি একমত হতে হয়, তাহলে আলাপের প্রয়োজনই বা কেন?”
এই প্রশ্নই যেন বলে দেয়— ঐকমত্য যতটা রাজনৈতিক, তার চেয়েও বেশি মনস্তাত্ত্বিক।
🟣 বাস্তবায়নের পথে বাধা, না কি সম্ভাবনা?
সনদ থাকলেই তো হলো না, বাস্তবায়নই আসল চাবিকাঠি।
এই প্রশ্নে বিভক্ত রাজনৈতিক মহল। ছয়টি বিকল্প বাস্তবায়ন পথ দেওয়া হলেও, দলগুলো ভাগ হয়ে গেছে দুই শিবিরে—
সংসদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন চান: বিএনপি, সিপিবি, বাসদসহ কয়েকটি দল
গণপরিষদের মাধ্যমে চান: এনসিপি ও ছাত্র আন্দোলনের নেতারা
উপেক্ষমাণ দল: জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি, যারা এখনো সিদ্ধান্তে আসেনি
অধ্যাপক রীয়াজ স্পষ্ট করে দিয়েছেন,
“আমরা বলব কী পরিবর্তন দরকার। কিভাবে হবে, সে সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক দল ও অন্তর্বর্তী সরকার নেবে।”
🟣 যদি সনদ না-ই হয়?
যদি জুলাই সনদ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে না হয়, তাহলে আগামী ৩ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণসমাবেশে ঘোষণা করা হবে ‘জুলাই ইশতেহার’।
এই বার্তা হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জনচাপ তৈরির অন্যতম হাতিয়ার।
🟣 ইতিহাসের পাতা কি নতুন করে লিখছে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন,
“জুলাই আমাদের যে বার্তা দিল, তার দলিল রাখতে হবে। এটাই হবে ২৪-এর গণআন্দোলনের দালিলিক ভিত্তি।”
তিনি যেমন বলেছেন,
“সবাই নিজেদের ভাষা এই সনদে দেখতে চায়। কিন্তু সব ভাষা যদি একসঙ্গে জায়গা চায়, তবে তো শব্দ হারিয়ে যায়।”
🟣 এক নজরে: জুলাই সনদ
📌 মূল উদ্দেশ্য: রাজনৈতিক সংস্কারে দলসমূহের ঐকমত্যের লিখিত দলিল
📌 প্রস্তাবনা: ১৬৬টি প্রস্তাব; ৮০টির বেশি প্রস্তাবে ঐকমত্য
📌 মূল পাঁচ বিষয়ের ঐক্য: সংবিধান, সীমানা, ক্ষমা, বিকেন্দ্রীকরণ
📌 বিভক্তি: বাস্তবায়ন পদ্ধতি ও কিছু মূলনীতি নিয়ে
📌 সময়সীমা: জুলাই শেষে বা ৩ আগস্টের মধ্যে ঘোষণার প্রস্তুতি
🔚 শেষ কথা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে বহু দলিল তৈরি হয়েছে, বহু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ‘জুলাই সনদ’ আলাদা— কারণ এটি এসেছে জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে, একটি বিপ্লবের চাওয়া নিয়ে।
এখন প্রশ্ন একটাই—
এই সনদ কেবল একটি ইতিহাস হবে, না কি একটি ভবিষ্যতের দিগন্তরেখা?
জাকারিয়া ইসলাম/
নিউজটি আপডেট করেছেন : Jatiyo Potrika
জুলাই সনদ কী, কেন এত বিতর্ক, কিভাবে বাস্তবায়ন হবে?
- আপলোড সময় : ০৬-০৭-২০২৫ ১০:৫৮:৩৭ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৬-০৭-২০২৫ ১০:৫৮:৩৭ অপরাহ্ন

সর্বশেষ সংবাদ